ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

যানজট নিরসনে ঢাকার সড়কে বসছে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:২৯, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

রাজধানী ঢাকার যানজট কমাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই বিশেষজ্ঞের পরামর্শে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই উদ্যোগ চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রস্তুতির কারণে এটি বাস্তবায়নে আরও ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার চারটি মোড়ে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে বসবে ট্রাফিক সিগন্যাল। এসব সিগন্যাল তৈরি করছে বুয়েট। আগামী এক মাসের মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের চারটি মোড়ে এসব ট্রাফিক সিগন্যাল লাগানোর কথা থাকলেও দাপ্তরিক জটিলতার কারণে কিছুটা সময় লাগবে।


বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ ও প্রকল্পের লক্ষ্য

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ও ড. হাদিউজ্জামানের ছয়টি সুপারিশের ভিত্তিতে রাজধানীর যানজট নিরসনের কাজ করছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। এর মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার চারটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিগন্যালগুলো তৈরি ও পরিচালনায় প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে বুয়েট।

ছয়টি সুপারিশের পাঁচটি সুপারিশ নিয়ে রাস্তায় কাজ করবে ট্র্যাফিক পুলিশ। আর পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে রাজধানীতে স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাফিক সিগন্যাল ফিরিয়ে আনতে সেগুলো বানানো ও ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে বুয়েট। পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার চারটি মোড়ে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে বসবে ট্রাফিক সিগন্যাল। এসব সিগন্যাল তৈরি করছে বুয়েট। আগামী এক মাসের মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের চারটি মোড়ে এসব ট্রাফিক সিগন্যাল বসানোর কথা বলা হয়েছে।

ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনকে দরপত্র আহ্বান, বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন এবং আরএসটিপি অনুমোদনের মতো দাপ্তরিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ, তবে প্রকল্প শুরু করতে আরও কিছু সময় প্রয়োজন।’

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম-

স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল:

ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, সার্ক ফোয়ারা এবং ফার্মগেট মোড়ে সিগন্যাল স্থাপনের কাজ চলতি তিন মাসে সম্পন্ন হবে। এই সিগন্যাল ব্যবস্থা ম্যানুয়ালি ও স্বয়ংক্রিয় উভয়ভাবেই পরিচালনা করা যাবে। প্রাথমিকভাবে ওয়াকিটকির মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তবে ভবিষ্যতে রিমোট কন্ট্রোল সুবিধা যুক্ত করা হবে।

পরিকল্পিত প্রযুক্তি ব্যবহার:

বুয়েটের ডিজাইন করা সিস্টেমের মাধ্যমে ডিফল্ট ফেজ টাইম নির্ধারণ এবং প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে। মাটি না খনন করে এইচডিডি পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন করা হবে।
প্রকিউরমেন্ট ও রক্ষণাবেক্ষণ:

প্রতিটি সিগন্যালের জন্য সাড়ে ১০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণে মাসে খরচ হবে দেড় লাখ টাকা। দুই সিটি করপোরেশন আলাদা আলাদা প্রকিউরমেন্ট করবে এবং বুয়েট প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।

পাইলট করিডর ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে হাইকোর্ট থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ২২টি জংশনে চালু হবে। প্রথম ধাপে চারটি মোড়ে কাজ শেষ হলে পরবর্তী তিন মাসে বাকি ১৮টি মোড়ে সিগন্যাল স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি পরিচালনায় বুয়েট থেকে প্রশিক্ষিত একজন অপারেটর থাকবে, যিনি স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

জানা যায়, পাইলট প্রকল্পটি নিয়ে এ পর্যন্ত চারটি সভা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ ও ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা ঠিক হয়। ১৬ অক্টোবর বুয়েটে অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্পের সরকারি অংশীজনদের ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা দেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। প্রকল্পের আওতায় এসব ট্রাফিক সিগন্যাল তৈরি করবে বুয়েট। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ৫ কোটি ৫ লাখ টাকার বাজেট দিয়েছে। প্রতিটি সিগন্যাল তৈরি ও স্থাপনের সাড়ে ১০ লাখ টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক দেড় লাখ টাকা চেয়েছে বুয়েট।

গত ১৬ অক্টোবরের সভাসূত্রে জানা যায়, দেশীয় প্রযুক্তিগত ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা ম্যানুয়্যালি নিয়ন্ত্রণ (হাতে পরিচালিত) করা যাবে। এটা সিগন্যাল পদ্ধতির সঙ্গে সংযুক্ত টাইম প্রিসেট ফ্যাসিলিটির (একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি বা সময়কাল আগেই ঠিক করা থাকে এবং সেই অনুযায়ী সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে) সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে। ইন্টারসেকশনের জন্য ডিফল্ট ফেজ টাইম (লাল, হলুদ, সবুজ প্রদর্শনের জন্য নির্ধারিত একটি প্রাথমিক বা স্থির সময়কাল) নির্দিষ্ট করা আছে। এটি চাইলে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা সম্ভব। ভুলবশত ডিফল্ট ফেজ টাইম অতিক্রান্ত হলে সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বাজিয়ে সতর্ক করবে। তবে শুরুতে রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার সুবিধা থাকবে না। প্রাথমিকভাবে ওয়াকিটকির মাধ্যমে কাজ চালানো হবে। ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য সংযোগ এইচডিডি পদ্ধতিতে (মাটি খনন না করেই ভূগর্ভস্থ পাইপ, কেবল, বা অন্যান্য অবকাঠামো স্থাপন করা হয়) নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

গত ২৮ অক্টোবর সভা থেকে জানা যায়, বুয়েটের ডিজাইন অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনাতে পথচারী রেলিং, রাস্তার চিহ্ন ও সাইন পোস্ট, সিগন্যাল লাইট পোস্ট, এইচডিডি পদ্ধতিতে আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল ডাক্ট, সাইট নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এসবের জন্য প্রকিউরমেন্ট (সরবরাহ বা ক্রয় প্রক্রিয়া) স্ব স্ব সিটি করপোরেশন করবে। বুয়েট থেকে দেওয়া প্রস্তাবনা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জন্য আলাদাভাবে দেবে। এ জন্য উভয় সিটি করপোরেশনকে বুয়েট বরাবর আলাদাভাবে চিঠি দেওয়ার জন্য বলে বুয়েট।

সভাসূত্র বলেছে, হাইকোর্ট–আব্দুল্লাহপুর পাইলট করিডরে মোট ২২টি জংশন আছে। এর মাঝে প্রথম অংশে আগামী তিন মাসে চারটি জংশনে (ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, সার্ক ফোয়ারা ও ফার্মগেট) সিগন্যালের কাজ সম্পন্ন হবে। পরবর্তী তিন মাসে বাকি ১৮টি জংশনে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হবে। বুয়েট থেকে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অপারেটর (নিয়ন্ত্রক) থাকবেন, যিনি মাঠ পর্যায়ে অপারেটরদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

দাপ্তরিক জটিলতা ও অগ্রগতি

২৮ অক্টোবরের সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, গাইডলাইন অনুযায়ী প্রকিউরমেন্ট করতে হবে। তবে বনানী স্টাফ কোয়ার্টার থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতাধীন। ফলে এই অংশে সিগন্যাল স্থাপনের জন্য অধিদপ্তর থেকে অনাপত্তিপত্র সংগ্রহ করতে হবে।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) সূত্র বলছে, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনাটি উভয় সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করবে এবং বুয়েট বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। বুয়েট আলাদা প্রস্তাব দেবে এবং সিটি করপোরেশন তাদের অংশের কাজ বাস্তবায়ন করবে। বনানী স্টাফ কোয়ার্টার থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সিগন্যাল স্থাপনের কাজ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন করবে এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর অনাপত্তিপত্র দেবে।

বুয়েটের দুই বিশেষজ্ঞের একজন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান গত শনিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সিটি করপোরেশন। এর জন্য সিটি করপোরেশন থেকে পরিমার্জিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বা আরএসটিপি অনুমোদন করতে হবে। সিটি করপোরেশনকে বৈদ্যুতিক লাইন, মাটি খনন করাসহ অন্যান্য বিষয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করতে হবে। বিষয়গুলো অফিশিয়ালি হতে হবে। এই প্রকল্পে বুয়েটকে সম্পৃক্ত করতে হলে তাদের প্রস্তাবনা দিতে হবে। সব মিলিয়ে ছয় মাস সময় লাগবে। তবে যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার অগ্রাধিকার রয়েছে সেহেতু তিন মাসের মধ্যে শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’

তিনি জানান, তাঁরা তাদের দিক থেকে পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছেন। ট্রাফিক পদ্ধতি চালু করার জন্য মাঠে যে তার (ওয়্যার) বসানো হবে সেটিও ঠিক করে রেখেছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, ‘বুয়েট থেকে পাওয়া আর্থিক প্রস্তাব প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন পেলেই আমরা কাজ শুরু করব।’

প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব

এই পাইলট প্রকল্প সফল হলে তা ঢাকার যানজট নিরসনে একটি কার্যকরী মডেল হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থার সঠিক বাস্তবায়ন পথচারী এবং যানবাহন চলাচলকে সুশৃঙ্খল করতে ভূমিকা রাখবে।

সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ এবং সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে প্রকল্পটি সময়মতো বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।


এসএস//
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি